দাতা সংস্থাগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে হাত খুলে টাকা দিতে চাচ্ছে বলে দাবি করেছেন সরকারের পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক শেষে বিকাল ৩টার দিকে শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ দাবি করেন।
এর আগে সকাল সাড়ে ১১টায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে একনেক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস
সরকার নিজস্ব অর্থায়নে চলমান প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাই করার চিন্তা করলেও বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পগুলো ত্বরান্বিত করতে চাচ্ছে বলে জানান পরিকল্পনা উপদেষ্টা। তিনি বলেন, দাতা সংস্থা এখন তো আমাদের সাহায্য করতে চাচ্ছে। তারা আমাদের হাত খুলে টাকা দিতে চাচ্ছে। কেন সেটা জানি না। যেমন ইউএসএইড বলেছে, তোমরা যেকোনও প্রকল্প নিয়ে আসো, আমরা দিয়ে দেবো, আমাদের কোনও সমস্যা নেই। অন্য দ্বিপক্ষীয়-বহুপক্ষীয় দাতারা বলছেন, আমরা অন্তর্বর্তী সরকার হলেও তাদের চলমান প্রকল্প চালিয়ে যেতে কোনও অসুবিধা নেই। এরপর এও বলেছে– আমাদের নতুন চাহিদার কথাও জানাতে বলেছে। তারা বলেছে যতদূর পারে তারা অর্থায়নের চেষ্টা করবে।
বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট বেশ কিছু প্রকল্প বহুদিন ধরে পড়ে আছে উল্লেখ করে উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, বৈদেশিক সাহায্যের একটি বিরাট পাইপলাইন পড়ে আছে। কিন্তু কেন পড়ে আছে সেটা জানি না। এগুলো ব্যবহার হচ্ছে না। হয়তো তাদের শর্ত ও আমরা যেভাবে যাচাই-বাছাই করি তাতে অমিল থেকে যায়। এছাড়া মনিটরিং বেশি হওয়ার কারণে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পগুলো ঠিকাদাররা বাস্তবায়নে আগ্রহী হন না।
প্রকল্পের পড়ে থাকা অর্থ
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের হিমাগারে বহু বছরের প্রকল্প পড়ে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প বেশ কয়েক বছর ধরে পড়ে আছে। এগুলোকে আমরা ‘মৃত্যু প্রকল্প’ বলতে পারি। দাতারা বলেছেন, এগুলো আমরা এখান থেকে ছাড় করে দিলে এই অর্থ তারা আমাদের বাজেট সহায়তার জন্য উন্মুক্ত করে দেবে। আমরা এই অর্থটা অবমুক্ত করে ডিসেম্বরের মধ্যে এই এক বিলিয়ন ডলার পেয়ে যাবো। অন্যান্য সংস্থারও পড়ে থাকা প্রকল্পের অর্থ নতুন প্রকল্পে দিতে রাজি রয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন হতো পিডি-ঠিকাদারদের ইচ্ছেমতো
উপদেষ্টা বলেন, বিগত দিনে নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রকল্প পাস করা হলেও বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে মন্ত্রণালয় মনের আনন্দে কাজ করতো। প্রকল্প পরিচালক, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা, ঠিকাদার মিলে প্রকল্প যেভাবেই অনুমোদন হোক না কেন, তারা তাদের মতো করে বাস্তবায়ন করতো। এ কারণে প্রকল্পে একাধিকবার সময় বাড়াতে হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হয়েছে। আমরা চিন্তা করেছি, যাচাই-বাছাই হবে, তবে যতটা সম্ভব আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে দ্রুত একনেকে তোলা হবে।
আমরা প্রকল্পের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধির চিন্তা করছি। এতে তাদের দায়বদ্ধতা থাকবে। বর্তমান প্রক্রিয়ায় প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হলে এর জন্য কে দায়ী সেটা চিহ্নিত করা কঠিন। আমরা এমন কোনও অপরিকল্পিত প্রকল্প নেবো না, যাতে অর্থের অপচয় হবে- যুক্ত করেন তিনি।
আগের সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রকল্প
তিনি বলেন, আমরা চূড়ান্তভাবে অনুমোদনের জন্য বেশি প্রকল্প খুঁজে পাচ্ছি না। তার কারণ এই প্রকল্পগুলোর সবগুলোই আগের সরকারের সময়কার। এর মধ্যে কিছু রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ প্রকল্প থেকে খুব বেশি লাভ পাওয়া যাবে না। এগুলো কমিশনের বর্তমান কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে বাছাই করে বাদ দিয়ে ফেলেছেন।
এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেকোনও রাজনৈতিক সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প নেবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু রাজনৈতিক মদতপুষ্ট অনেক স্বার্থগোষ্ঠীর জন্য অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়। অথবা প্রকল্প ভালো হলেও সেগুলোতে অপচয় হয়। এটাকে আমি রাজনৈতিক প্রকল্প নয়, অপরাজনৈতিক প্রকল্প বলবো।
তিনি জানান, মন্ত্রণালয়গুলো চাচ্ছে চলমান প্রকল্পগুলো আরও যাচাই বাছাই করে দেখতে, কিন্তু আবার বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পগুলো যাচাই বাছাই করতে গেলে সময় চলে যাবে। এ জন্য আমরা একনেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অন্তত বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পগুলো বেশি যাচাই বাছাইয়ের সময় না দিয়ে একনেকে পাস করে দেবো। পরে মন্ত্রণালয় এগুলো দাতাদের সঙ্গে আলোচনা করে পরিমার্জন ও সংশোধন করতে পারবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা
একনেকে পাস হওয়া ‘তথ্য আপা: ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়র লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন’- এই প্রকল্পের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে অনেক ভালো কাজের তালিকা রয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশের নাম নিয়ে অনেকটা রাজনৈতিক প্রপাগান্ডার কাজও করেছে। ছাত্র-গণআন্দোলনের সময়ও বিরোধী পক্ষের (বিগত সরকারের পক্ষে) ভূমিকাও তারা পালন করেছেন। সরকার এই প্রকল্পের সঙ্গে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও যুক্ত করতে চায়।
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনে সময় বৃদ্ধির প্রস্তাব
ব্যবসায়ীরা এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনে সময় বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে সরকারের চিন্তা কী জানতে চাইলে ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, উত্তরণের জন্য যে কমিটি যাচাই বাছাই করে সে কমিটি সাধারণত এটা গ্রহণ করে না। আমার অভিমত হচ্ছে বাংলাদেশের মতো এত বড় জনগোষ্ঠী ও অর্থনীতির দেশ এলডিসিতে থাকারই কথা নয়। স্বাধীনতার পর আমরা যে এলডিসিতে ঢুকেছিলাম, আসলে আমার এখানে ঢোকার কথা ছিল না। এর মধ্যে দুইবারই তিনটি যোগ্যতার ক্ষেত্রে আমাদের সুপারিশ করা হয়েছে। কাজেই আমার মনে হয় এক্ষেত্রে চেষ্টা করে কোনও লাভ হবে না।
বাজেটের আকার জানতে অপেক্ষা করতে হবে
চলতি অর্থবছরে উন্নয়ন ব্যয় কমানোর পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, এই বছরের বাজেটে শেষ পর্যন্ত অর্থ সংস্থান কত হবে, বৈদেশিক সাহায্য কত পাওয়া যাবে এবং উন্নয়ন বাজেট কত বড় হবে– এটা এখনও প্রাক্কলন করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ রাজস্ব আদায় তো প্রতি বছরই একটা অনিশ্চয়তা থাকে। এ বছর অনেক কিছু পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেলো। অর্থনৈতিক অস্থিরতা তো রয়েছেই। এ জন্য এখনই উন্নয়ন বাজেটের আকার কী হবে তা বলা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, আমাদের চিন্তা হচ্ছে আমরা কিছু দিন আস্তে আস্তে চলবো। এরপর আমরা হিসাব করবো আমাদের সম্পদ কত? আর এই অর্থবছরে বৈদেশিক সাহায্য কী পরিমাণ পেতে পারি। ফলে আরও ৪/৫ মাস পরে বুঝতে পারবো আমাদের উন্নয়ন বাজেট কতটুকু হওয়া উচিত। সে সময়ে আমরা নিজেদের অর্থায়নেও ছোট ছোট জরুরি কিছু প্রকল্প গ্রহণ করবো।
তিনি বলেন, এটা সবাই জানি ম্যাক্রো অর্থনীতিতে টানাপড়েন চলছে। আশা করি বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে এক জায়গায় এসে (টাকা ও ডলার) স্বস্তির হবে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ কতটা হবে এবং মূল্যস্ফীতি কমাতে গেলে আমাদের বাজেট ঘাটতি কোথায় রাখতে হবে সেটা বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। কারণ মূল্যস্ফীতি কমানোটাকে অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি। টাকার অপচয় না হয়, দুর্নীতি না হয়, এটা আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এতে যদি কম ব্যয় হয়, বাজেটের আকার কম হয় তাতে কোনও অসুবিধা নেই বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।পরিকল্পনামন্ত্রী গাজীপুর-বিমানবন্দর ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, আমি নিজে মনে করি এই প্রকল্পটি ভুল হয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন ভবিষ্যতে এই প্রকল্প হয়তো ভাঙতে হতে পারে।