# দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম
# অল্প কিছু সংস্কারের মধ্যেমেই স্টেডিয়ামকে আন্তর্জাতিক ভেন্যু হিসেবে প্রস্তুত করা সম্ভব
দীর্ঘ ১৮ বছর পর শহীদ চান্দু ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আবারও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজনের স্বপ্ন দেখছে বগুড়াবাসী। ২০০৬ সালে সর্বশেষ কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিরো এই স্টেডিয়ামে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় শিকার হয়ে গত প্রায় দেড়যুগ বগুড়ার এই মাঠে আর কোন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়নি।
মাত্র ৫টি ওয়ানডে এবং একটি টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হওয়ার পর বগুড়া জেলা বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত থাকায় কৌশলে সরিয়ে নেওয়া হয় আন্তর্জাতিক ম্যাচের ভেন্যু। সেই থেকে অবহেলায় পড়ে ছিলো স্টেডিয়ামটি। ২০২৩ সালের শুরুর দিকে তো ঘরোয়া কোনো ক্রিকেট ম্যাচও আয়োজন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো বিসিবি। যে কারণে তারা সব স্টাফকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলো তখন। এখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারনে আবারো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের বল গড়ানোর স্বপ্ন দেখছে এখানকার মানুষ।জানা যায়, ১৯৬২ সালে নির্মিত স্টেডিয়ামটি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭০ সালে যাত্রা শুরু হয়। ওই সময় ফুটবল, ক্রিকেটসহ স্থানীয় নানা খেলাধুলা অনুষ্ঠিত হতো। পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানও হতো এ স্টেডিয়ামে।
দীর্ঘদিন এভাবে চলার পর ২০০৩ সালের ৩ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বগুড়া শহীদ চান্দু ক্রীড়া কমপ্লেক্সের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। প্রায় ৮ কোটি টাকা ব্যায় করে সংস্কারের পর ২০০৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি স্টেডিয়ামের আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।
অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিশ্বকাপের ম্যাচ দিয়ে যাত্রা শুরু হয় বগুড়ার এই স্টেডিয়ামের। আইসিসির স্বীকৃতি পাওয়ার পর একটি মাত্র টেস্ট ম্যাচ আর ৫টি ওয়ানডে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। যার মধ্যে টেস্টে বাংলাদেশ ১০ উইকেটে হারে লঙ্কানদের কাছে। ৫ ওয়ানডের মধ্যে ৪ ম্যাচে জয় এবং একটি ম্যাচে পরাজিত হয়।
এর মধ্যে শ্রীলংকার বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয় পায় টাইগাররা। শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামেই সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কাকে প্রথমবারের মত হারানোর রেকর্ড গড়ে টাইগাররা। যদিও শ্রীলঙ্কার কাছে অন্য ম্যাচে হেরে যায় বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কা ছাড়াও এই মাঠে কেনিয়ার বিরুদ্ধে একটি এবং জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে দুটি ম্যাচে জয় পায় বাংলাদেশ।
১৮ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতার স্টেডিয়ামটিতে শ্রীলঙ্কাকে প্রথমবার হারানোর দিন বগুড়া এবং উত্তরাঞ্চলের ২৪ হাজার দর্শক নাচে-গানে আনন্দের সেই দিনটিকে উদযাপন করেছিলো। বগুড়ার মানুষ ক্রিকেটের জন্য এরপর আর আনন্দে মেতে ওঠার সুযোগ পায়নি।
২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় বগুড়ার শহীদ চান্দু ক্রিকেট। এরপর টানা ১৮ বছর বগুড়ায় বসেনি কোন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ। আইসিসির স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও ঘরোয়া ক্রিকেট পর্যন্ত বন্ধ হয়ে আছে স্টেডিয়ামটিতে।স্রেফ যেন একটি জায়গা দখল করে আছে স্টেডিয়ামটি। স্টাফদের বেতন পরিশোধ থাকলেও বিদ্যুৎ বিল বকেয়া। মাঠের আউটফিল্ড, পিচ সংস্কার করা প্রয়োজন। ইনডোর, জিমনেশিয়াম এখন প্রায় অকেজো। স্টেডিয়ামের সাথে নির্মাণ করা সুইমিংপুলটি মাঝে কয়েকবার চালু করা হলেও এখন প্রায় ১০ বছরের বেশি সময় ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এই মাঠে কুচকাওয়াজ, বিভিন্ন জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠান পালন করা হয়েছে। পরে জেলা ক্রীড়া সংস্থা অলিখিত একটি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে স্টেডিয়ামটিকে।জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক নেতৃবৃন্দ বলছেন, ‘বগুড়ার স্টেডিয়ামটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে। এই মাঠের উইকেট অত্যন্ত ভালোমানের হওয়ার পরও বিসিবি এখান থেকে ভেন্যু সরিয়ে নিয়ে যায়।’বগুড়ায় আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনে আইসিসির স্বীকৃতি থাকা সত্ত্বেও বিসিবির কিছু কর্মকর্তা প্রতিহিংসা পারয়ন হয়ে এই মাঠ থেকে বিএনপির নাম মুছে দিতে এখানে ম্যাচ আয়োজন করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে।
আন্তর্জাতিক ম্যাচ না থাকায় সংস্কারসহ অবকাঠামোর কোন উন্নয়নও করা হয়নি। লাখ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রাখা হয়েছে। ফ্লাড লাইট স্ট্যান্ড থেকে দামি লাইটগুলোও খুলে নেয়া হয়েছে।তবে আওয়ামী সরকার বিদায় নেয়ার পর এখন এই স্টেডিয়মে আবারও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজনের দাবি জানিয়েছেন বগুড়ার ক্রীড়া সংগঠক ও খেলাপ্রেমীরা।
বগুড়ার ক্রিকেটপ্রেমীরা জানালেন, ক্রিকেটকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে এবং ক্রিকেটের উন্নয়নের স্বার্থে শুধু ঢাকা, চট্রগ্রাম, খুলনা নয় বগুড়ার মত অন্য জেলাগুলোতেও আন্তর্জাতিকমানের ম্যাচ দিতে হবে। ক্রিকেটকে আরো ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে আরো বেশি ক্রিকেটের কাছে আসতে পারবে তরুণ প্রজন্ম।তারা বলছেন, ‘দেশের ক্রিকেট এখন ঢাকা চট্রগ্রামে মধ্যে সীমাবদ্ধ। যার কারণে স্টেডিয়ামটিকে এখন বোঝা না মনে করে পূর্বের মত আবারো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ দিতে হবে। বগুড়ার ক্রীড়াঙ্গনের যে অবদান রয়েছে তা তুলে ধরতেই আন্তর্জাতিক ম্যাচ দিয়ে বগুড়াবাসির ১৮ বছর ধরে দেখে আসা স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।
’বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক নির্বাহী সদস্য ও ক্রীড়া সংগঠক অ্যাথলেট শাজাহান আলী বাবু বলেন, ‘বগুড়ার এই স্টেডিয়ামটি নষ্ট করেছেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। তারা বগুড়াকে কুক্ষিগত করার জন্য ইচ্ছে করে একটি জীবন্ত মাঠের মৃত্যু ঘটিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অবহেলায় থাকা এই স্টেডিয়ামের সংস্কারের কোনো অর্থ নেই, বিদ্যুৎ বিল বকেয়া, সুইমিংপুল বন্ধ, ইনডোরে খুবই বাজে অবস্থা, উইকেট ঠিক থাকলেও এর আউটফিল্ড ঠিক নেই।’‘এই স্টেডিয়ামের পূর্ণাঙ্গ মেরামত করতে হবে। তারা চায়নি আরাফাত রহমান কোকোর হাতে গড়া বগুড়া শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হোক শুধুমাত্র প্রতিহিংসার কারণে এই আধুনিক স্টেডিয়ামটি নষ্ট করা হয়েছে। এই স্টেডিয়ামটি সংস্কার করে আবারো আন্তর্জাতিকম্যাচ আয়োজনের জন্য আমরা সবাই মিলেই চেষ্টা করবো। এই মাঠে আবারো আন্তর্জাতিক ম্যাচ ফিরিয়ে আনার জন্য সবার সহযোগিতা কামনা করা হচ্ছে।’
বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকার বাইরে যে সব আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম আছে তার মধ্যে বগুড়া উল্লেখযোগ্য। বগুড়ার আবাসন ব্যবস্থা এখন অন্য জেলার চেয়ে অনেক উন্নত। বগুড়ায় বেশ কিছু আন্তর্জাতিকমানের হোটেল মোটেল চালু রয়েছে। দেশের অন্য স্টেডিয়ামের তুলনায় বগুড়ার স্টেডিয়ামের যোগাযোগসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভালোও। তবুও এখানকার স্টেডিয়ামটিকে বঞ্চিত করা হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে এই বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে।’‘
আগামীদিনে আমরা এই মাঠে আবারো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজনের জন্য যা যা করনীয় তার সবই করবো। বগুড়ার একঝাঁক ক্রিকেটার আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দায়িত্বের সাথে খেলে জাতীয় ক্রিকেট দলের জন্য অবদান রেখে যাচ্ছেন। নাম বললে, মুশফিকুর রহীম, তাওহিদ হৃদয়, তানজিদ তামিম, শফিউল ইসলাম সুহাস এবং নারী ক্রিকেটারও রয়েছে একঝাঁক। দেশের উত্তরাঞ্চলের ক্রিকেটকে আরো এগিয়ে নিতে বগুড়ায় আরো বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন করা প্রয়োজন।’
শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের ভেন্যু ম্যানেজার জামিলুর রহমান বলেন, ‘উত্তরবঙ্গের একমাত্র টেস্ট ভেন্যু হলো বগুড়া। এখানে উন্নতমানের উইকেট থাকায় ভালো কিছু হওয়া সম্ভব। তবে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে অবকাঠামোগত জটিলতা দেখা দিয়েছে। কিছু ভবন ও গ্যালারির সংস্কার প্রয়োজন। মাঠের পানি নিষ্কাশনের জন্যও কিছু কাজ করতে হবে। এছাড়া বিদ্যুতের জন্য আলাদা সাব-স্টেশন নির্মাণ করাসহ ফ্লাড লাইটগুলোর মেরামত করা হলে এটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাবে।’