ভারতের ত্রিপুরা, একটি ছোট কিন্তু ঐতিহাসিক রাজ্য, যেখানে সংস্কৃতি ও ইতিহাস একত্রিত হয়ে অসাধারণ এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। গোমতী নদী বয়ে চলেছে এখানে, আর তার তীরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিখ্যাত ভুবনেশ্বরী মন্দির, যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের পটভূমি। আমি যখন আগরতলায় এসে প্রতিদিন বৃষ্টির মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলাম, তখন একটি আকর্ষণীয় পরিকল্পনা মাথায় এল— উদয়পুরে গিয়ে সেই ঐতিহাসিক মন্দিরগুলি দেখা।
সকালবেলা, বন্ধু বিপ্লব সাহার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি উদয়পুরের সাংবাদিক এবং বললেন, “আমি তোমাকে রাজা গোবিন্দমাণিক্যের সেই মন্দির ঘুরিয়ে দেখাব।” তাঁর এই কথা শুনে মনটা আনন্দে ভরে গেল। রবীন্দ্রনাথের লেখার যে প্রভাব, তা যেন আমাকে আরও উৎসাহী করে তুলল।
বাসে চড়ে যখন উদয়পুরের পথে রওনা হলাম, তখন জানালার বাইরে দিয়ে সবুজ গাছপালা, কৃষিজমি আর ছোট ছোট গ্রামগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমি এক সুন্দর ছবির মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছি। ব্রহ্মাবাড়ি বাস স্ট্যান্ডে নেমে বিপ্লবকে ফোন করলাম। তিনি দ্রুত এলেন, এবং তাঁর স্কুটারে করে উদয়পুরের দর্শনীয় স্থানে বেরিয়ে পড়লাম।
গোমতী নদী বহমান
প্রথমেই আমরা গুণাবতী মন্দিরে গেলাম। বৃষ্টিভেজা দুপুরে মন্দির চত্বরে এক নৈশব্দ বিরাজ করছিল। প্রাচীন তিনটি মন্দিরের কম্পাউন্ডে দাঁড়িয়ে, আমি ভাবছিলাম রাজা গোবিন্দমাণিক্য এবং তাঁর স্ত্রী মহারাণী গুণাবতী সম্পর্কে। মন্দিরগুলোর স্থাপত্যশৈলী অসাধারণ, কিন্তু তাদের প্রতিষ্ঠাকাল আজও রহস্যময়।
এরপর গোমতী নদীর পাড়ে গেলাম। নদীটি টলমল স্রোতে বইছে, যেন রাজ্যের ইতিহাসের গল্প বলছে। সেখানে দাঁড়িয়ে, আমি অনুভব করলাম যে এক সময় এখানে নরবলী হত। তবে আজকের দিনটি মানবতার জয়গান গায়, যা এই স্থানকে একটি নতুন অর্থ দেয়।
বিপ্লব বললেন, “এই ভুবনেশ্বরী মন্দিরটি রাজর্ষির মূল প্রেক্ষাপট।” মন্দিরের বিশাল পাকুড় গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে, আর নদীর কূলে থাকা দৃশ্য আমাকে মায়াবী পরিবেশে বন্দী করে ফেলল। এই স্থানে দাঁড়িয়ে আমি ইতিহাসের শেকড়ে প্রবেশ করতে পারছিলাম।
এরপর রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের দিকে গেলাম। প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের মাঝে দাঁড়িয়ে, ইতিহাসের আভাস পেয়েছিলাম। এখানে রাজা গোবিন্দমাণিক্যের রণকৌশল, তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, সবকিছু যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল।
আগরতলা রাজবাড়ী
বিকেলবেলা, আমরা ফিরে এলাম আগরতলায়। সারাদিনের ভ্রমণে আমি এক নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। বিপ্লবের সঙ্গে এই সফর শুধু আনন্দই দেয়নি, বরং আমাকে ইতিহাসের এক নতুন পাঠে প্রবেশ করিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের চেতনাকে অনুভব করে আমি বুঝতে পারলাম, আমাদের সমাজে মানবতার জয়গান গাওয়া খুবই জরুরি। গোমতী নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে, আমি অনুভব করছিলাম—এখানে ইতিহাসের শেকড় গেঁথে আছে, এবং সে শেকড় আমাদের সকলকে একত্রিত করে।
এমনকি বৃষ্টির মধ্যে কাকভেজা হয়ে, আমি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম, তা আমাকে রাজা গোবিন্দমাণিক্য এবং তাঁর সময়ে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের গভীরতা উপলব্ধি করায় সাহায্য করল। প্রতিটি মন্দির, প্রতিটি নদী—এসব কিছুর মধ্যে রয়েছে একটি জীবন্ত ইতিহাস, যা আমাদের চিন্তার দিগন্তকে প্রসারিত করে।
এই ভ্রমণের প্রতিটি মুহূর্ত যেন রবীন্দ্রনাথের কাহিনীর সঙ্গে মিশে গিয়ে একটি নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করল। ‘রাজর্ষি’ এবং ‘বিসর্জন’ নাটকের বিষয়বস্তু, এ সবই আমাকে ভেবে দিতে লাগল, মানবতা কখনো হারবে না, বরং সত্য ও ন্যায়ের জয় হবেই।