বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাতের জন্য সবচেয়ে আতঙ্কজনক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিকর রোগগুলোর একটি হলো ক্ষুরা রোগ বা ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ (FMD)। প্রতিবছর হাজার হাজার গরু ও অন্যান্য গবাদিপশু এই ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হয়, যার ফলে খামারি ও কৃষকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
এই রোগ বয়স্ক গরুতে উৎপাদন হ্রাস করে এবং বাছুরদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এর ফলে শুধু পশুর স্বাস্থ্যই নয়, দুগ্ধ উৎপাদন, উৎপাদনশীলতা এবং পশু রপ্তানির সম্ভাবনাও হুমকির মুখে পড়ে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গোলজার হোসেন ক্ষুরা রোগের লক্ষণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, ক্ষুরা রোগ একটি অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাসজনিত রোগ, যা গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া এবং শুকরের মতো দ্বিখুরবিশিষ্ট প্রাণীদের আক্রান্ত করে। এ রোগের ভাইরাস পিকোর্নাভিরিডি পরিবারের অ্যাপথো-ভাইরাস গণভুক্ত। এটি একটি সিঙ্গেল স্ট্র্যান্ডেড, পজিটিভ সেন্স RNA ভাইরাস, যার সাতটি স্বতন্ত্র সিরোটাইপ রয়েছে— ‘O’, ‘A’, ‘C’, ‘SAT-1’, ‘SAT-2’, ‘SAT-3’ এবং ‘Asia-1’। বাংলাদেশে প্রধানত ‘O’, ‘A’ ও ‘Asia-1’ সিরোটাইপের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।তিনি জানান, সংক্রামিত পশুর লালা, দুধ, মল-মূত্র, এমনকি নিঃশ্বাসের মাধ্যমেও ভাইরাসটি বাতাসে ছড়াতে পারে। সংক্রমণ ছড়াতে পারে যেকোনো সংস্পর্শ, খাদ্য-পানীয়, যন্ত্রপাতি কিংবা বাহকের মাধ্যমেও। বাহক হিসেবে মানুষ, কুকুর, পাখি, যানবাহন প্রভৃতিও ভূমিকা রাখে।
ড. গোলজার বলেন, বর্ষা মৌসুমের পর এবং শীতের শুরুতে ক্ষুরা রোগের প্রকোপ বাড়ে। এই সময়ের আর্দ্রতা, জলাবদ্ধতা এবং অপর্যাপ্ত জীবাণুনাশ ব্যবস্থা রোগ বিস্তারের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে।ক্ষুরা রোগের লক্ষণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন— আক্রান্ত পশুর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠা, মুখ, জিহ্বা, দাঁতের গাম, ঠোঁট, ক্ষুর এবং দুধের টিটে ফোস্কা হওয়া, অতিরিক্ত লালা ঝরানো, খুঁড়িয়ে হাঁটা, দুধ উৎপাদন কমে যাওয়া, খাওয়ার অনীহা এবং বিষণ্নতা। বাছুরদের ক্ষেত্রে টাইগার হার্ট নামে মারাত্মক হৃদরোগও দেখা দেয়, যা হঠাৎ মৃত্যু ঘটাতে পারে।
এই রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই বলে জানান অধ্যাপক। তিনি বলেন, সহায়ক চিকিৎসা এবং সঠিক যত্নের মাধ্যমেই আক্রান্ত প্রাণীকে সুস্থ করা সম্ভব। জীবাণুনাশক দ্রবণে মুখ ও ক্ষুর ধুয়ে দেওয়া, ব্যথানাশক ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে সেকেন্ডারি ইনফেকশন প্রতিরোধ করা হয়। আক্রান্ত পশুকে আলাদা করে রাখা, নরম খাবার দেওয়া এবং বিশ্রামে রাখাও প্রয়োজন।খামারিদের জন্য পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ক্ষুরা রোগ প্রতিরোধে নিয়মিত টিকা প্রদান, খামারে জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বাহ্যিক পশু প্রবেশ বন্ধ রাখা, যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত রাখা, নতুন পশুকে অন্তত ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখা, এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।তিনি সতর্ক করেন, খামারিদের কিছু সাধারণ ভুল যেমন— টিকা না দেওয়া, আক্রান্ত পশুকে আলাদা না রাখা, অপরিচ্ছন্নতা ও সচেতনতার অভাব— ক্ষতি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক ও বাহরাইনে ‘SAT-1’ নামে নতুন একটি সিরোটাইপ দেখা দিয়েছে, যা পরবর্তীতে কুয়েত ও তুরস্কেও ছড়িয়ে পড়ে। এই সিরোটাইপ নতুন হওয়ায়, এ অঞ্চলে রোগ প্রতিরোধে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন।
অধ্যাপক জানান, ক্ষুরা রোগ বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ খাতে বড় অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ। একে প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো— নিয়মিত টিকাদান, খামারে জৈব নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং খামারিদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা। সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা নিলে এই রোগের প্রভাব অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব।