ঢাকাTuesday , 1 October 2024
আজকের সর্বশেষ খবর

বাংলাদেশের সংবিধান পুনঃলিখনের প্রয়োজনীয়তা: বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা ও প্রেক্ষাপটের বিশ্লেষণ

জিয়া চৌধুরী
October 1, 2024 10:36 pm
Link Copied!

বাংলাদেশের সংবিধান পুনঃলিখনের প্রয়োজনীয়তা এবং প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের প্রথমে সংবিধান পুনঃলিখনের বৈশ্বিক ইতিহাস এবং সেসব দেশগুলোতে পুনঃলিখনের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। একইসাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে কেন এবং কীভাবে সংবিধান পুনঃলিখন করা যেতে পারে, তা নির্ণয় করাও গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে সংবিধান পুনঃলিখন

অনেক দেশ তাদের সংবিধান পুনঃলিখন করেছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা, এবং আধুনিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী দেশের শাসনব্যবস্থাকে নতুন রূপ দিতে। উদাহরণস্বরূপ:

১. দক্ষিণ আফ্রিকা: ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সংবিধান পুনঃলিখন করে, যেখানে বর্ণবৈষম্যের অবসান এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা ছিল প্রধান লক্ষ্য। এই প্রক্রিয়াটি শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা এবং তাঁর সহকর্মীরা। সংবিধানটি পুনর্লিখনে কয়েক বছর লেগেছিল এবং জনগণের মতামত গ্রহণ করার জন্য বিভিন্ন স্তরের অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়েছিল। এর ফলে দেশের স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক চেতনা প্রতিষ্ঠিত হয়।

২. ইকুয়েডর: ২০০৮ সালে ইকুয়েডরও একটি নতুন সংবিধান গ্রহণ করে। এর মূল লক্ষ্য ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার, আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষা, এবং দেশীয় সম্পদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। এ প্রক্রিয়াটিও গণভোটের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং সংবিধানটি একটি নতুন রাজনৈতিক ধারার প্রবর্তন করে, যার মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছিল।

৩. বোলিভিয়া: ২০০৯ সালে বোলিভিয়া একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে, যার লক্ষ্য ছিল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকারের স্বীকৃতি, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর জনগণের মালিকানা নিশ্চিতকরণ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ। এই সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইভো মোরালেস, এবং এটি সফলভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে।এই দেশগুলোতে সংবিধান পুনঃলিখনের অভিজ্ঞতা দেখে বোঝা যায় যে, প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছু বড় ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে সংবিধান পুনঃলিখন করা হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সাধারণত কয়েক বছর সময় লাগে এবং তাৎপর্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যয়ও হয়। তবে পুনঃলিখিত সংবিধানগুলো সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপনে সহায়ক হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংবিধান পুনঃলিখন কেন জরুরী?

বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালে প্রণীত হয়েছিল, এবং এটি দেশটির প্রতিষ্ঠাকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক আদর্শের প্রতিফলন ছিল। তবে বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ফলে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সংবিধান পুনঃলিখন করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।

১. রাজনীতির অস্থিতিশীলতা ও ক্ষমতার ভারসাম্য: বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা। সংবিধানের ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার বিধানগুলো কখনও কখনও বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিরোধ করার জন্য নতুন সংবিধান কিংবা বিদ্যমান সংবিধানের সংস্কার প্রয়োজন হতে পারে।

২. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও, বর্তমানে এটি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের শিকার হতে পারে বলে অনেকের মতামত। সুতরাং, বিচার বিভাগের কার্যক্রমকে আরো স্বচ্ছ ও স্বাধীন করতে সংবিধানে পুনরায় নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

৩. মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার: বর্তমান সংবিধানে মানবাধিকার সম্পর্কিত ধারা রয়েছে, তবে সেগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন প্রায়শই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আধুনিক সময়ের চাহিদা অনুযায়ী অধিকারগুলোকে আরো সুসংহত এবং বাস্তবসম্মতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।

৪. নির্বাচন প্রক্রিয়া: বাংলাদেশের সংবিধানে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারাবাহিকতা থাকা সত্ত্বেও সময়ে সময়ে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য সংবিধান পুনঃলিখন বা সংশোধন করা যেতে পারে।

কোন পন্থা অবলম্বন করতে হবে?

বাংলাদেশে সংবিধান পুনঃলিখন একটি সংবেদনশীল এবং জটিল প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে কিছু বিশেষ পন্থা অনুসরণ করা যেতে পারে:

১. সর্বজনীন আলোচনা ও অংশগ্রহণ: সংবিধান পুনঃলিখন একটি অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া হওয়া উচিত, যেখানে সকল রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ জনগণ মতামত প্রদান করতে পারবেন। এ ধরনের আলোচনা গণভোটের মাধ্যমে সংবিধানের স্বীকৃতি পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

২. বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন: সংবিধান পুনঃলিখনের জন্য দেশের খ্যাতনামা আইনবিদ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এই কমিটি আইনের বিভিন্ন দিক এবং দেশের সাম্প্রতিক অবস্থা পর্যালোচনা করে সংবিধান খসড়া তৈরি করতে পারে।

৩. রাজনৈতিক সমঝোতা: এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, সংবিধান পুনঃলিখনের ক্ষেত্রে কোনো একক রাজনৈতিক দল বা পক্ষের আধিপত্য না থাকে। এতে সংবিধানের গ্রহণযোগ্যতা ও বৈধতা বৃদ্ধি পাবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করলে সংবিধান সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।

কী কী বিষয় সামনে রেখে পুনঃলিখন করা উচিত?

১. গণতন্ত্রের দৃঢ় ভিত্তি: গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী ও সুরক্ষিত করতে সংবিধানে স্পষ্ট বিধান থাকতে হবে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে দায়িত্বশীলতা প্রতিষ্ঠার দিকনির্দেশনা সংবিধানে উল্লেখ করা প্রয়োজন।

২. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা উচিত, যাতে বিচার ব্যবস্থায় কোনো রাজনৈতিক প্রভাব বা হস্তক্ষেপ না থাকে।

৩. মানবাধিকার: মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলো যেমন বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, শারীরিক নিরাপত্তা, এবং সামাজিক ন্যায়বিচার সংবিধানে আরো সুসংহত ও কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

৪. পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদঃ বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে পরিবেশ সংরক্ষণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানে বিশেষ ধারা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের নদী, বন, এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার জন্য সংবিধানে প্রতিশ্রুতি থাকা জরুরি।

৫. অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতা: দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে সংবিধানে বিশেষ বিধান থাকা উচিত, যাতে দেশের প্রত্যেক নাগরিক সমান অধিকার ও সুযোগ পায়।

উপসংহার

সংবিধান পুনঃলিখনের প্রয়োজনীয়তা বিশ্বের অনেক দেশে দেখা গেছে, এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি অংশগ্রহণমূলক এবং প্রগতিশীল সংবিধান পুনঃলিখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

------------------------------------   এই সাইটে নিজস্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো। বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।